বগুড়া কাহালু উপজেলা পরিচিতি

বগুড়া কাহালু উপজেলা পরিচিতি

একনজরে বগুড়া কাহালু উপজেলা পরিচিতি, যার নামকরণের ইতিহাস খুব বেশি দীর্ঘ না হলেও জনশ্রুতিতে এর পেছনে একটি ইতিহাসের খোঁজ মেলে। শোনা যায় তৎকালীন সময়ে নামকরা একজন দরবেশ গাজী জিয়া উদ্দীনের ছোট ভাই দরবেশ হযরত শাহ সুফী সৈয়দ কালু বর্তমান কাহালু থানার পার্শ্বে এসে তাঁর আস্তানা গড়েন। এবং তারপর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে ওই জনপদে ইসলাম ধর্মের প্রচার করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি এই এলাকায় মৃত্যুবরন করলে কালু বাবার মাজার নামে তার একটি মাজার করা হয়। তারই নামানুসারে পরবর্তীতে এই এলাকার নামকরণ হয় ‘‘কাহালু’’ নামে। 

কাহালু উপজেলা সর্বপ্রথম ১৯২৮ সালে একটি প্রশাসনিক থানা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বগুড়া জেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে কাহালু উপজেলা অবস্থিত।

ভৌগলিক অবস্থান ও আয়তন

কাহালু উপজেলার উত্তরে শিবগঞ্জ ও বগুড়া সদর উপজেলা, দক্ষিণে নন্দীগ্রাম উপজেলা, পূর্বে বগুড়া সদর ও শাজাহানপুর উপজেলা, এবং পশ্চিমে দুপচাঁচিয়া উপজেলা ও আদমদীঘি উপজেলা রয়েছে। এ উপজেলার আয়তন প্রায় ২৩৮.৭৯ বর্গ কিলোমিটার। এর অবস্থান২৪°৪৩´ থেকে ২৪°৫৭´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°০৯´থেকে ৮৯°১৯´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।

জনসংখ্যার উপাত্ত

এ উপজেলার সর্বমোট জনসংখ্যা প্রায় ২,১৯,০০০ জন; তন্মধ্যে পুরুষ জনসংখ্যা প্রায় ১,১০,০০০ জন এবং মহিলার সংখ্যা প্রায়  ১,০৯,০০০ জন। জনসংখ্যার সর্বমোট ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯১৭ জন। এছাড়াও এখানে মোট ভোটার সংখ্যা রয়েছে ১,৪৬,৭৮৬ জন। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার সংখ্যা প্রায় ৭১,৫০১ জন এবং মহিলা ভোটার সংখ্যা রয়েছে প্রায় ৭৫,২৮৫ জন। এ এলাকায় সর্বমোট ৫১,৩২৬ টি পরিবার বসবাস করে। এবং বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মোট ০.৮৯ %।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

অন্য এক জনশ্রুতিতে জানা যায়, একসময় এই এলাকাটি একটি হিন্দুপ্রধান এলাকা ছিলো। আর তাই সেই সুবাদে এখানে প্রচুর ধোপা শ্রেণীর লোকেরা বসবাস করতো। বর্তমান কাহালু পাইলট হাইস্কুলের দক্ষিণ ও পশ্চিম পার্শ্বে সেইসময়  মরাগাংগী নামের একটি খাল ছিলো। যেখানে এই ধোপারা তাদের কাপড় ধোয়া ও শুকানোর কাজ করতো। এই ধোপা শব্দ থেকেই কালভেদে এই এলাকার নাম হয় ধোপচাঁচিয়া। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রাচীনকালে এই এলাকায় ধূপের চাষাবাদ এর আধিক্য ছিলো। আর সেখান থেকেই ধূপচাঁচিয়া, যা পরবর্তীতে বগুড়া কাহালু উপজেলা পরিচিতি পায়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৭১ সালের অক্টোবরের প্রায় শেষের দিকে কাহালু উপজেলার নশিরপাড়া ও কড়িবামুজা এলাকায় পাকিস্তানী পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেই সময় এ উপজেলার আরো বিভিন্ন জায়গাগুলোতে পাকবাহিনী ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায় এবং স্থানী ঘরবাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। অতঃপর ১৯৭১ এর  ১৩ ডিসেম্বর এ উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়।

কাহালু উপজেলায় বেশকিছু ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঐতিহাসিক যোগীর ভবনের মন্দির, কাহালু জমিদার বাড়ীর নট মন্দির, মুরইল জমিদার বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ, শাল বাহন রাজার প্রাসাদ, দধি সাগর, অচিন গাছ, মশমা দিঘী, বাঁকা দিঘী, পীড়াপাট গোরক্ষনাথ মন্দির। এছাড়াও বেশকিছু উল্লেখযোগ্য মাজারও রয়েছে যেমন: কালু পীরের মাজার, নলডুবি মাজার, পাঁচপীর মাজার, সতীকন্যা সাহেবানীর মাজার প্রভৃতি। 

কাহালু উপজেলার দর্শনীয় স্থান

অচিন গাছ

কাহালু উপজেলার মুরইল গ্রামের জমিদার সৈয়দ আঃ রফ চৌধুরীর বাসভবণের পশ্চিম পার্শ্বে ‘‘অচিন গাছ’’ নামক এ গাছটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, যেটি নিয়ে এলাকার মানুষের মনে নানান কৌতূহল রয়েছে। এর বয়সকাল নিয়েও নানা ধরনের অনিশ্চিত মন্তব্য শোনা যায়। এলাকাবাসীর মতে, এই গাছটির বয়স প্রায় তিনশত থেকে চারশত বছর। তবে এই গাছে কোনো ধরনের ফুল এবং ফল হয় না। এছাড়াও জনশ্রুতিতে, এই গাছটি এখানে অলৌকিকভাবে জন্ম নিয়েছে। 

এই গাছ দর্শনে যেতে হলে বগুড়া বাসষ্ট্যান্ড থেকে বাস যোগে মুরইল বাসষ্ট্যান্ড হয়ে দক্ষিণে ১ কিলোমিটার পাকা রাস্তা পায়ে হেঁটে  অথবা রিক্সাযোগে যেতে হবে।

ঐতিহাসিক যোগীর ভবনের মন্দির

ঐতিহাসিক যোগীর ভবনের মন্দির বগুড়া জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এবং কাহালু উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তরে পাইকড় ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের কাছে অবস্থিত।

বিভিন্ন জনশ্রুতি থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী যোগীর ভবনের মন্দির একটি প্রাচীন আশ্রম ও মন্দির। ভারত বিভক্ত হওয়ার আগ অব্দি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাধু-সন্ন্যাসীদের আগমনের কারণে প্রায় প্রতিদিনই এখানে ভক্তদের বেশ আনাগোনা ছিলো। এখানকার ধর্মটুঙ্গিতে প্রায় সবসময় আগুনের কুন্ডলি জ্বালানো হতো। আর এই জ্বলন্ত আগুনের কুন্ডলীর চারপাশে বসে প্রায় দিনরাতই চলতো ধর্মীয় আলোচনা। 

বগুড়া বাসষ্ট্যান্ড থেকে বাসযোগে দররগাহাট বাজার। এরপর সেখান থেকে রিক্সা বা সিএনজি যোগে পাইকড়র ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়া যায়।

কাহালু উপজেলার দর্শনীয় স্থান

শাল বাহন রাজার প্রাসাদ

কাহালু সদর উপজেলা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে পাইকড় ইউনিয়নের আড়োলা গ্রামে রয়েছে শাল বাহন রাজার রাজপ্রসাদ। প্রাচীন কালের এ রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ থেকে এর অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া যায়।

শোনা যায়, রাজা শাল বাহন ছিলেন পাল বংশের একজন শাসনকর্তা। তার একজন কন্যা ছিলো, যার নাম ছিলো অড়োলা দেবী। জানা যায়, রাজার এই কন্যার নামানুসারে এ গ্রামের নামকরণ হয় ‘‘আড়োলা’’। এলাকাবাসীর ধারণা, এই প্রাসাদটি দশম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত।

বগুড়া বাসষ্ট্যান্ড থেকে বাসযোগে দরগাহাট বাসষ্ট্যান্ড। এরপর সেখান থেকে রিক্সা বা সিএনজি যোগে আড়োলা বাজারে যাওয়া যায়।

কাহালু উপজেলার দর্শনীয় স্থান

শিক্ষা

কাহালু উপজেলায় বর্তমানের গড় শিক্ষার হার ৫৬.৫%। এই উপজেলায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা সর্বমোট ৭৩টি, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংখ্যা ১টি, বে-সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মোট ৩৭টি, উচ্চ বিদ্যালয়(সহশিক্ষা) ২২টি, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ৪ টি, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় মোট ৫ টি। এছাড়াও মাদ্রাসা রয়েছে ২৮ টি। তন্মধ্যে দাখিল মাদ্রাসা ১৯ টি, ফাজিল মাদ্রাসা ৫ টি, এবং আলিম মাদ্রাসা সংখ্যা ৪টি। এই উপজেলায় সর্বমোট ৫ টি কলেজ রয়েছে। তার মধ্যে কলেজ(সহপাঠ) ০৪ টি এবং মহিলা কলেজ রয়েছে ১ টি। তন্মধ্যে

উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ হচ্ছে: কাহালু উচ্চ বিদ্যালয়, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৪ সালে, এবং নারহট্ট উচ্চ বিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৮ সালে।

কাহালু উচ্চ বিদ্যালয়

কাহালু সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় যা ১৯৪৪ সালে  কাহালু উচ্চ বিদ্যালয় নামে স্বীকৃতি লাভ করে। বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলা সদরে এই বিদ্যালয়টি অবস্থিত। বিদ্যালয়টিতে সর্বপ্রথম পাঠদান শুরু হয় ১৯০০ সালের শুরুতে। তৎকালীন জমিদার বাবু পেরিলাল মজুমদারের ক্রয়কৃত জমিদারিত্বে দিঘির উত্তর-পূর্বকোণে একটি বটগাছের নিচে তৃতীয় শ্রেনী পর্যন্ত পাঠদান শুরু হয়। এর পরবর্তীতে ১৯১০ সালে এটি জেলা বোর্ডের আওতায় M.F.P স্কুল নামে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত চালু হয়। অতঃপর ১৯২০ সালে তৎকালীন জমিদারের পুত্র কুমুদ রঞ্জণ, জমিদার কালিপদ মজুমদার এবং বিদ্যানুরাগী মরহুম তশরতুল্ল্যাহ কবিরাজ এর নেতৃত্বে ৫ম শ্রেণী থেকে উন্নীত হয়ে একাধারে ৯ম এবং ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান চালু হয়। এবং পরবর্তীতে এটি ১ জানুয়ারী ১৯৪৪ সালে  কাহালু উচ্চ বিদ্যালয় নামে স্বীকৃত হয়।

বগুড়া কাহালু উপজেলা পরিচিতি

 

অর্থনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্য

অর্থনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যে কাহালু উপজেলা বগুড়া জেলার অন্যান্য উপজেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম উন্নত একটি উপজেলা। এখানকার প্রধান উৎপাদিত ফসলগুলো হলোঃ ধান, গম, আলু, সরিষা ছাড়াও অন্যান্য ফসলাদি।  অন্যান্য উপজেলার তুলনায় এখানে পুকুরের পরিমাণ অনেক বেশি, যেগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে মাছের চাষ করা হয়। 

এই উপজেলায় প্রায় ১০ টিরও বেশি মৎস্য হ্যাচারী রয়েছে যেগুলোতে বিপুল পরিমাণ মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও এখানে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য শিল্প কারখানা রয়েছে। তন্মধ্যে কাজীপাড়া পেপার মিল লিমিটেড, কাজীপাড়া সুতলী মিল লিমিটেড, আর বি এ্যাগো লিমিটেড, আল ফারুক ব্যাগ ইন্ডাট্রিজ লিমিটেড, কোয়ালিটি ফিডস লিমিটেড, বগুড়া ভান্ডার ও জুট মিল লিমিটেড, আরেফিন জুট মিলস ও কোল্ড ষ্টোরেজ, নেট মিলস লিমিটেড অন্যতম। 

এই উপজেলায় মোট জমির পরিমাণ প্রায় ২৪,০৫৪ হেক্টর। তার মধ্যে মোট ফসলী জমি রয়েছে প্রায় ৫৫,৮৫৬ হেক্টর, এবং নীট ফসলী জমি ২০,৬৯০হেক্টর। এখানকার বাৎসরিক খাদ্য চাহিদা সর্বমোট ৩৭,৯৯০মেঃ টন এবং বাৎসরিকখাদ্য উৎপাদন ১,৩২,০০০মে: টন। 

কাহালু ইউনিয়ন পরিষদ

সর্বমোট ৯ টি ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে কাহালু উপজেলা গঠিত হয়েছে। যেগুলো হলোঃ

কাহালু ইউনিয়ন পরিষদ

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বসমূহ

বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম হোসেন আলী

জীবনকাল: ১ লা জুলাই ১৯৪৮ – ১ ই ডিসেম্বর ২০১২

বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম হোসেন আলী একাধারে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা, এবং কাহালু থানার মুক্তিযোদ্ধাকালীন কমান্ডার। তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জনের পর  কাহালু সদরে উপজেলার নামানুসারে ১৯৭৩ সালে কাহালু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি ২০০৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ১ ই ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কাহালু কলেজ মসজিদ প্রাঙ্গনে (গেটের সামনে) তার সমাধি রয়েছে।

কাহালু উপজেলা মানচিত্র

কাহালু উপজেলা মানচিত্র

পরিশেষে

নাগর নদী কাহালু উপজেলার মধ্য দিয়ে বহমান। প্রবাহমান এই নদীর জলের মতোই সাধারণ কাহালু উপজেলার গ্রামীন জনজীবন। ১৯৮৩ সালে উপজেলা হিসেবে স্বীকৃত কাহালু এলাকা বগুড়ার অন্যান্য উপজেলার মতোই শিক্ষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও যোগাযোগে উন্নত। কাহালু উপজেলা বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহি ও অন্যতম ব্যবসায়িক জনপদ। এখানকার মানুষের ঐতিহ্য, ব্যবসায়িক কৌশল, এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান বগুড়া কাহালু উপজেলা পরিচিতিকে করেছে অতি সমৃদ্ধ।

1 thought on “বগুড়া কাহালু উপজেলা পরিচিতি”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *